রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেমের কবিতা | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতার লাইন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এই কবিতাগুলোতে প্রেমের বিভিন্ন রূপ – প্রেমের আনন্দ, বেদনা, বিরহ, এবং আধ্যাত্মিক প্রেমের অভিব্যক্তি সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেমের কবিতা | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতার লাইন
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ – সাহিত্যের সকল শাখাতেই তিনি ছিলেন অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা বাংলা সাহিত্যকে নতুন দিগন্ত দান করেছে। তার কবিতা আজও পাঠকদের মনে সমানভাবে আবেগ জাগিয়ে তোলে।

পেজ সূচিপত্রঃ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেমের কবিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঙালির মনের মানুষ, যিনি কেবল কবিই নন, একজন সাহিত্যিক, দার্শনিক, ও সমাজ সংস্কারক। তাঁর সাহিত্যের বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃতি রয়েছে, আর তার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবদান হল প্রেমের কবিতা। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রেমের বিভিন্ন রূপ ফুটে উঠেছে – রয়েছে প্রথম প্রেমের মধুর কামনা, বিরহের বেদনা, অবিশ্রুত প্রেমের আকুলতা, এমনকি দাম্পত্য জীবনের স্নেহ ও মমতা।
এই লেখায়, আমরা রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি জনপ্রিয় প্রেমের কবিতা নিয়ে আলোচনা করব, যেগুলো আজও পাঠকদের মনে জাগে অনুভূতির ঝড়:
  • চিরকুমার সভা: এই কবিতায় প্রথম প্রেমের মধুর স্মৃতি ও বিরহের বেদনা ফুটে উঠেছে। বিরহের জ্বালায় কবি প্রিয়াকে ফিরে পেতে আকাশের তারাদের কাছে আকুল আবেদন জানান।
  • আমার সোনার বাংলা: এই মাতৃভূমির প্রশংসা গীতিতে প্রেমের একটি অনন্য দিক ফুটে উঠেছে। কবি বাংলাদেশকে তার প্রেমিকার সাথে তুলনা করেছেন, যার প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ও নিষ্ঠা রয়েছে।
  • চলে যেতে দাও একবার: এই কবিতায় বিচ্ছেদের বেদনাকে মর্মস্পর্শীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। তিনি চান তাঁর প্রিয়াকে একবার চলে যেতে দিতে, যাতে তিনি নিজের মনের বেদনা উপলব্ধি করতে পারেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতাগুলি শুধু কবিতা নয়, বরং অনুভূতির এক অমর সৃষ্টি। প্রেমের বিভিন্ন রূপকে এত সুন্দর ও স্পর্শকাতুরভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি আজও বাঙালি সাহিত্যে অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য প্রেমের কবিতা বাঙলা সাহিত্যের ধন। এগুলি প্রেমের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে, পাঠকের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। তবে, এই কবিতাগুলি পড়তে গিয়ে আপনার মনে হয়তো কিছু প্রশ্ন জাগতে পারে। এখানে সেই প্রশ্নাবলীর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হলো:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেমের কবিতা কোনটি?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক জনপ্রিয় প্রেমের কবিতা রয়েছে, তবে “চলে যেতে দাও” এবং “আমি কেন তোমায় ভালোবাসি” দুটি কবিতা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় বলে বিবেচিত হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতায় প্রেমের কী ধরণের চিত্র ফুটে ওঠে?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতায় প্রেমের বিভিন্ন দিক চিত্রিত হয়েছে। যেমন, প্রথম প্রেমের সারল্য, বিরহের বেদনা, অবিমিশ্র প্রেমের গভীরতা, প্রেমের আধ্যাত্মিক উচ্চতা ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু প্রেমের কবিতা কি আত্মজৈবনিক?

কিছু গবেষক মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের বিভিন্ন সম্পর্কের প্রতিফলন তাঁর কিছু প্রেমের কবিতায় পাওয়া যায়। তবে, সব কবিতাকেই সরাসরি আত্মজৈবনিক বলে মনে করা ঠিক নয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতা পড়ে কী লাভ?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতা পড়ে আমরা প্রেমের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানতে পারি। এছাড়াও, ভাষার সৌন্দর উপভোগ করতে পারি, মনের অনুভূতিকে আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সমৃদ্ধ করতে পারি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতার লাইন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, কেবল একজন লেখকই ছিলেন না, বরং একজন দার্শনিক, সঙ্গীতজ্ঞ, এবং চিত্রশিল্পীও ছিলেন। তার অসাধারণ প্রতিভার স্পর্শে সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখাই। তার কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক – সকলের মধ্যেই ফুটে উঠেছে জীবনের বিভিন্ন রঙ।
আর তার প্রেমের কবিতাগুলি! বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে এগুলি যেন অমূল্য রত্ন। প্রেমের সুখ, দুঃখ, আকাঙ্ক্ষা, আশা – সবকিছুই ফুটে উঠেছে তার এই কবিতাগুলিতে।
রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতার কিছু স্মরণীয় লাইন:
  • “তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শত বার”
  • “চোখের জলে ভিজে যায় পাতা, ঝরে যায় ফুল”
  • “এই মোম জ্বলন্ত আঁধারে, কে জানে কতক্ষণ জ্বলবে”
  • “হৃদয় আমার আকাশ-পটে, জীবন আমার কোমল বিভায়”
  • “দুজনার প্রেমে পূর্ণ হল দুটি হৃদয়”
  • “তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে, থাকি বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা”
  • “ভালোবাসার গান গেয়েছি, দিনে দিনে সুখগান থেমে গেল”
  • “সে দেবীপ্রতিমা নারিব ভুলিতে প্রথম প্রণয় আঁকিল যাহা”
  • “এ ভালোবাসার যদি দিতে প্রতিদান”
  • “অচির বসন্ত হায় এল, গেল চলে”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতাগুলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। প্রেমের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এই কবিতাগুলি আজও পাঠকদের মনে ছুঁয়ে যায়।

অত চুপি চুপি কেন কথা কও

(উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
অত চুপি চুপি কেন কথা কও
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।
অতি ধীরে এসে কেন চেয়ে রও,
ওগো একি প্রণয়েরি ধরন।
যবে সন্ধ্যাবেলায় ফুলদল
পড়ে ক্লান্ত বৃন্তে নমিয়া,
যবে ফিরে আসে গোঠে গাভীদল
সারা দিনমান মাঠে ভ্রমিয়া,
তুমি পাশে আসি বস অচপল
ওগো অতি মৃদুগতি-চরণ।
আমি বুঝি না যে কী যে কথা কও
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।

 

হায় এমনি করে কি, ওগো চোর,
ওগো মরণ, হে মোর মরণ,
চোখে বিছাইয়া দিবে ঘুমঘোর
করি হৃদিতলে অবতরণ।
তুমি এমনি কি ধীরে দিবে দোল
মোর অবশ বক্ষশোণিতে।
কানে বাজাবে ঘুমের কলরোল
তব কিঙ্কিণি-রণরণিতে?
শেষে পসারিয়া তব হিম-কোল
মোরে স্বপনে করিবে হরণ?
আমি বুঝি না যে কেন আস-যাও
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।

 

কহ মিলনের এ কি রীতি এই
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।
তার সমারোহভার কিছু নেই–
নেই কোনো মঙ্গলাচরণ?
তব পিঙ্গলছবি মহাজট
সে কি চূড়া করি বাঁধা হবে না।
তব বিজয়োদ্ধত ধ্বজপট
সে কি আগে-পিছে কেহ ববে না।
তব মশাল-আলোকে নদীতট
আঁখি মেলিবে না রাঙাবরন?
ত্রাসে কেঁপে উঠিবে না ধরাতল
ওগো মরণ,হে মোর মরণ?

 

যবে বিবাহে চলিলা বিলোচন
ওগো মরণ, হে মোর মরণ,
তাঁর কতমতো ছিল আয়োজন,
ছিল কতশত উপকরণ।
তাঁর লটপট করে বাঘছাল
তাঁর বৃষ রহি রহি গরজে,
তাঁর বেষ্টন করি জটাজাল
যত ভুজঙ্গদল তরজে।
তাঁর ববম্‌ববম্‌ বাজে গাল,
দোলে গলায় কপালাভরণ,
তাঁর বিষাণে ফুকারি উঠে তান
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।

 

শুনি শ্মশানবাসীর কলকল
ওগো মরণ, হে মোর মরণ,
সুখে গৌরীর আঁখি ছলছল,
তাঁর কাঁপিছে নিচোলাবরণ।
তাঁর বাম আঁখি ফুরে থরথর,
তাঁর হিয়া দুরুদুরু দুলিছে,
তাঁর পুলকিত তনু জরজর,
তাঁর মন আপনারে ভুলিছে।
তাঁর মাতা কাঁদে শিরে হানি কর
খেপা বরেরে করিতে বরণ,
তাঁর পিতা মনে মানে পরমাদ
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।

 

তুমি চুরি করি কেন এস চোর
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।
শুধু নীরবে কখন নিশি-ভোর,
শুধু অশ্রু-নিঝর-ঝরন।
তুমি উৎসব করো সারারাত
তব বিজয়শঙ্খ বাজায়ে।
মোরে কেড়ে লও তুমি ধরি হাত
নব রক্তবসনে সাজায়ে।
তুমি কারে করিয়ো না দৃক্‌পাত,
আমি নিজে লব তব শরণ
যদি গৌরবে মোরে লয়ে যাও
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।

 

যদি কাজে থাকি আমি গৃহমাঝ
ওগো মরণ, হে মোর মরণ,
তুমি ভেঙে দিয়ো মোর সব কাজ,
কোরো সব লাজ অপহরণ।
যদি স্বপনে মিটায়ে সব সাধ
আমি শুয়ে থাকি সুখশয়নে,
যদি হৃদয়ে জড়ায়ে অবসাদ
থাকি আধজাগরূক নয়নে,
তবে শঙ্খে তোমার তুলো নাদ
করি প্রলয়শ্বাস ভরণ–
আমি ছুটিয়া আসিব ওগো নাথ,
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।

 

আমি যাব যেথা তব তরী রয়
ওগো মরণ, হে মোর মরণ,
যেথা অকূল হইতে বায়ু বয়
করি আঁধারের অনুসরণ।
যদি দেখি ঘনঘোর মেঘোদয়
দূর ঈশানের কোণে আকাশে,
যদি বিদ্যুৎফণী জ্বালাময়
তার উদ্যত ফণা বিকাশে,
আমি ফিরিব না করি মিছা ভয়–
আমি করিব নীরবে তরণ
সেই মহাবরষার রাঙা জল
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।

আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে

কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,
আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,
এই সংগীতমুখরিত গগনে
তব গন্ধ করঙ্গিয়া তুলিয়ো।
এই বাহিরভূবনে দিশা হারায়ে
দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।

 

অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে
আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রে –
দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া
আজি ব্যকুল বসুন্ধরা সাজে রে।
মোর পরানে দখিন বায়ু লাগিছে,
কারে দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে,
এই সৌরভবিহবল রজনী
কার চরণে ধরণীতলে জাগিছে।
ওগো সুন্দর, বল্লভ, কান্ত,
তব গম্ভীর আহবান কারে।

আজিকে গহন কালিমা লেগেছে গগনে

(উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
আজিকে গহন কালিমা লেগেছে গগনে, ওগো,
দিক্‌-দিগন্ত ঢাকি।
আজিকে আমরা কাঁদিয়া শুধাই সঘনে, ওগো,
আমরা খাঁচার পাখি–
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
আজি কি আসিল প্রলয়রাত্রি ঘোর।
চিরদিবসের আলোক গেল কি মুছিয়া।
চিরদিবসের আশ্বাস গেল ঘুচিয়া?
দেবতার কৃপা আকাশের তলে কোথা কিছু নাহি বাকি?–
তোমাপানে চাই, কাঁদিয়া শুধাই আমরা খাঁচার পাখি।

 

ফাল্গুন এলে সহসা দখিনপবন হতে
মাঝে মাঝে রহি রহি
আসিত সুবাস সুদূরকুঞ্জভবন হতে
অপূর্ব আশা বহি।
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
মাঝে মাঝে যবে রজনী হইত ভোর,
কী মায়ামন্ত্রে বন্ধনদুখ নাশিয়া
খাঁচার কোণেতে প্রভাত পশিত হাসিয়া
ঘনমসী-আঁকা লোহার শলাকা সোনার সুধায় মাখি।–
নিখিল বিশ্ব পাইতাম প্রাণে আমরা খাঁচার পাখি।

 

আজি দেখো ওই পূর্ব-অচলে চাহিয়া, হোথা
কিছুই না যায় দেখা–
আজি কোনো দিকে তিমিরপ্রান্ত দাহিয়া, হোথা
পড়ে নি সোনার রেখা।
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
আজি শৃঙ্খল বাজে অতি সুকঠোর।
আজি পিঞ্জর ভুলাবারে কিছু নাহি রে–
কার সন্ধান করি অন্তরে বাহিরে।
মরীচিকা লয়ে জুড়াব নয়ন আপনারে দিব ফাঁকি
সে আলোটুকুও হারায়েছি আজি আমরা খাঁচার পাখি।

 

ওগো আমাদের এই ভয়াতুর বেদনা যেন
তোমারে না দেয় ব্যথা।
পিঞ্জরদ্বারে বসিয়া তুমিও কেঁদো না যেন
লয়ে বৃথা আকুলতা।
হৃদয়বন্ধু, শুন গো বন্ধু মোর,
তোমার চরণে নাহি তো লৌহডোর।
সকল মেঘের ঊর্ধ্বে যাও গো উড়িয়া,
সেথা ঢালো তান বিমল শূন্য জুড়িয়া–
“নেবে নি, নেবে নি প্রভাতের রবি’ কহো আমাদের ডাকি,
মুদিয়া নয়ান শুনি সেই গান আমরা খাঁচার পাখি।

অচির বসন্ত হায় এল, গেল চলে

(উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
অচির বসন্ত হায় এল, গেল চলে–
এবার কিছু কি, কবি করেছ সঞ্চয়।
ভরেছ কি কল্পনার কনক-অঞ্চলে
চঞ্চলপবনক্লিষ্ট শ্যাম কিশলয়,
ক্লান্ত করবীর গুচ্ছ। তপ্ত রৌদ্র হতে
নিয়েছ কি গলাইয়া যৌবনের সুরা–
ঢেলেছ কি উচ্ছলিত তব ছন্দঃস্রোতে,
রেখেছ কি করি তারে অনন্তমধুরা।
এ বসন্তে প্রিয়া তব পূর্ণিমানিশীথে
নবমল্লিকার মালা জড়াইয়া কেশে
তোমার আকাঙক্ষাদীপ্ত অতৃপ্ত আঁখিতে
যে দৃষ্টি হানিয়াছিল একটি নিমেষে
সে কি রাখ নাই গেঁথে অক্ষয় সংগীতে।
সে কি গেছে পুষ্পচ্যুত সৌরভের দেশে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনন্ত প্রেম

(কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি)
তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার–
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।

 

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।

 

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।

 

আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি।

 

অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।
এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো,
কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।
বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,
দেশ বিদেশে কতই ঘুরি –
এবার বলো আমার মনের কোণে
দেবে ধরা, ছলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।

 

জানি আমার কঠিন হৃদয় চরণ রাখার যোগ্য সে নয় –
সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়
তবু কি প্রাণ গলবে না।
না হয় আমার নাই সাধনা, ঝরলে তোমার কৃপার কণা
তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল
চকিতে ফল ফলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসময়

(চৈতালি কাব্যগ্রন্থ)
বৃথা চেষ্টা রাখি দাও। স্তব্ধ নীরবতা
আপনি গড়িবে তুলি আপনার কথা।
আজি সে রয়েছে ধ্যানে—এ হৃদয় মম
তপোভঙ্গভয়ভীত তপোবনসম।
এমন সময়ে হেথা বৃথা তুমি প্রিয়া
বসন্তকুসুমমালা এসেছ পরিয়া,
এনেছ অঞ্চল ভরি যৌবনের স্মৃতি—
নিভৃত নিকুঞ্জে আজি নাই কোনো গীতি।
শুধু এ মর্মরহীন বনপথ-’পরি
তোমারি মঞ্জীর দুটি উঠিছে গুঞ্জরি।
প্রিয়তমে, এ কাননে এলে অসময়ে,
কালিকার গান আজি আছে মৌন হয়ে।
তোমারে হেরিয়া তারা হতেছে ব্যাকুল,
অকালে ফুটিতে চাহে সকল মুকুল।

আছে আমার হৃদয় আছে ভরে

কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
আছে আমার হৃদয় আছে ভরে,
এখন তুমি যা খুশি তাই করো।
এমনি যদি বিরাজ’ অন্তরে
বাহির হতে সকলই মোর হরো।
সব পিপাসার যেথায় অবসান
সেথায় যদি পূর্ণ করো প্রাণ,
তাহার পরে মরুপথের মাঝে
উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর।

 

এই যে খেলা খেলছ কত ছলে
এই খেলা তো আমি ভালবাসি।
এক দিকেতে ভাসাও আঁখিজলে,
আরেক দিকে জাগিয়ে তোল’ হাসি।
যখন ভাবি সব খোয়ালাম বুঝি
গভীর করে পাই তাহারে খুঁজি,
কোলের থেকে যখন ফেল’ দূরে
বুকের মাঝে আবার তুলে ধর’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজি গন্ধবিধুর সমীরণে

(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
আজি গন্ধবিধুর সমীরণে
কার সন্ধানে ফিরি বনে বনে।
আজি ক্ষুব্ধ নীলাম্বর-মাঝে
এ কী চঞ্চল ক্রন্দন বাজে।
সুদূর দিগন্তের সকরুণ সংগীত
লাগে মোর চিন্তায় কাজে–
আমি খুঁজি কারে অন্তরে মনে
গন্ধবিধুর সমীরণে।

 

ওগো জানি না কী নন্দনরাগে
সুখে উৎসুক যৌবন জাগে।
আজি আম্রমুকুলসৌগন্ধ্যে,
নব- পল্লব-মর্মর ছন্দে,
চন্দ্র-কিরণ-সুধা-সিঞ্চিত অম্বরে
অশ্রু-সরস মহানন্দে
আমি পুলকিত কার পরশনে
গন্ধবিধুর সমীরণে।

আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার

(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার,
পরানসখা বন্ধু হে আমার।
আকাশ কাঁদে হতাশ-সম,
নাই যে ঘুম নয়নে মম,
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম,
চাই যে বারে বার।
পরানসখা বন্ধু হে আমার।

 

বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,
তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
সুদূর কোন্‌ নদীর পারে,
গহন কোন্‌ অন্ধকারে
হতেছ তুমি পার।
পরানসখা বন্ধু হে আমার।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের দৃষ্টি

(সঞ্চয়িতা কাব্যগ্রন্থ)
বুঝি গো সন্ধার কাছে শিখেছে সন্ধার মায়া
ওই আঁখিদুটি,
চাহিলে হৃদয়-পানে মরমেতে পড়ে ছায়া,
তারা উঠে ফুটি।
আগে কে জানিত বল কত কি লুকানো ছিল
হৃদয়নিভৃতে–
তোমার নয়ন দিয়া আমার নিজের হিয়া
পাইনু দেখিতে।
কখনো গাও নি তুমি, কেবল নীরবে রহি
শিখায়েছ গান–
স্বপ্নময় শান্তিময় পূরবী রাগিণীতানে
বাঁধিয়াছ প্রাণ।
আকাশের পানে চাই সেই সুরে গান গাই
একেলা বসিয়া।
একে একে সুরগুলি অনন্তে হারায়ে যায়
আধারে পশিয়া।।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এই কবিতাগুলো আজও পাঠকদের মনে সমানভাবে আবেগ জাগিয়ে তোলে। প্রেমের বিভিন্ন রূপ অনুধাবন করতে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতাগুলো পড়া উচিত।
Scroll to Top