রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ৫০টি প্রেমের কবিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতা বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি তার অসাধারণ লেখনীর মাধ্যমে প্রেমের বিভিন্ন রূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই ৫০টি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের অন্তরের গভীর প্রেমের অনুভূতি ফুটে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা সাহিত্যের একজন দিকপাল ব্যক্তিত্ব, কেবল একজন লেখক হিসেবেই নয়, একজন দার্শনিক, সুরকার, এবং সমাজ সংস্কারক হিসেবেও সমাদৃত। তার লেখনীর সমাহারে প্রেমের বিভিন্ন রূপের অসাধারণ প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতাগুলি শুধু প্রেমের অনুভূতিই প্রকাশ করে না, বরং জীবনের বিভিন্ন দিক, প্রকৃতির সৌন্দর্য, এবং আধ্যাত্মিকতার আলোয়ও আলোকিত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যজগতে প্রবেশ করলেই মনে হয় যেন মৃদু হাওয়ায় মাতাল প্রেমের সুর। তাঁর কবিতাগুলোতে প্রেমের নানা রূপ ফুটে উঠেছে – মধুর প্রথম দেখা থেকে বৈরাগ্যের মৃদু ছোঁয়া পর্যন্ত। প্রতিটি কবিতা যেন এক অমর সুর, যা পাঠকের মনকে নাড়িয়ে দেয়, চিন্তা জাগিয়ে দেয়, আর হৃদয়কে ভরে দেয় অনাবিল আবেগে।
রবীন্দ্রনাথের প্রেম কবিতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর বৈচিত্র্য। তিনি লিখেছেন প্রথম দেখার সজল আকর্ষণ, রোমান্টিক প্রেমের মধুরতা, বিরহের ব্যথা, বৈরাগ্যের শান্তি, এমনকি প্রকৃতির প্রতি প্রেমের অপূর্ব বর্ণনা। তাঁর কবিতায় প্রেমের কোনো একটা সংজ্ঞা নেই, বরং প্রেমের নানা স্তর, নানা মাত্রা ফুটে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের প্রেম কবিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর গভীরতা। তিনি কেবল প্রেমের বাহ্যিক চিত্রই আঁকেননি, বরং প্রেমের অন্তর্নিহিত এক্সপ্রেশন (অভিব্যক্তি) গুলোও ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কবিতায় প্রেমের আনন্দ, ব্যথা, আশা, নিরাশা (নিরাশা), স্বপ্ন, বাস্তব, সবকিছুই মিশে আছে। এই গভীরতার কারণেই তাঁর কবিতাগুলি পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে।
শেষ পর্যন্ত, রবীন্দ্রনাথের প্রেম কবিতাগুলি চিরন্তন আবেদন রাখে। প্রেমের অনুভূতি সব মানুষের মধ্যেই থাকে, তাই তাঁর কবিতাগুলি সব সময়ই সব মানুষের কাছে সাড়া জাগিয়ে তোলে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই কবিতাগুলি পড়ে মুগ্ধ হয়, অনুভূত হয়, এবং নিজের মধ্যে প্রেমের নতুন আলো খুঁজে পায়।
রবীন্দ্রনাথের প্রেম কবিতাগুলি যদি আপনার পড়া হয়নি, তাহলে আজই শুরু করুন। এই অমর সুরের সঙ্গে হারিয়ে যান, প্রেমের নানা রূপ উপভোগ করুন, এবং নিজের মধ্যে প্রেমের অপূর্ব অনুভূতি খুঁজে পান।

অনন্ত প্রেম
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
যত শুনি সেই অতীত কাহিনী,
প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলনকথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে
দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া
তোমারি মুরতি এসে,
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে,
মিলনমধুর লাজে—
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।
আজি সেই চিরদিবসের প্রেম
অবসান লভিয়াছে
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ,
নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে
সকল প্রেমের স্মৃতি—
সকল কালের সকল কবির গীতি।

অকর্মার বিভ্রাট
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
লাঙল কাঁদিয়া বলে ছাড়ি দিয়ে গলা,
তুই কোথা হতে এলি ওরে ভাই ফলা?
যেদিন আমার সাথে তোরে দিল জুড়ি
সেই দিন হতে মোর মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি।
ফলা কহে, ভালো ভাই, আমি যাই খ’সে,
দেখি তুমি কী আরামে থাক ঘরে ব’সে।
ফলাখানা টুটে গেল, হল্খানা তাই
খুশি হয়ে পড়ে থাকে, কোনো কর্ম নাই।
চাষা বলে, এ আপদ আর কেন রাখা,
এরে আজ চালা করে ধরাইব আখা।
হল্ বলে, ওরে ফলা, আয় ভাই ধেয়ে–
খাটুনি যে ভালো ছিল জ্বলুনির চেয়ে।

১৪০০ সাল
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতুহলভরে,
আজি হতে শতবর্ষ পরে!
আজি নব বসন্তের প্রভাতের আনন্দের
লেশমাত্র ভাগ,
আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,
আজিকার কোনো রক্তরাগ-
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব কি পাঠাইতে
তোমাদের করে,
আজি হতে শতবর্ষ পরে?
তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার
বসি বাতায়নে
সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি
ভেবে দেখো মনে-
একদিন শতবর্ষ আগে
চঞ্চল পুলকরাশি কোন্ স্বর্গ হতে ভাসি
নিখিলের মর্মে আসি লাগে,
নবীন ফাল্গুনদিন সকল-বন্ধন-হীন
উন্মত্ত অধীর,
উড়ায়ে চঞ্চল পাখা পুষ্পরেণুগন্ধমাখা
দক্ষিণসমীর
সহসা আসিয়া ত্বরা রাঙায়ে দেয়েছে ধরা
যৌবনের রাগে,
তোমাদের শতবর্ষ আগে।
সেদিন উতলা প্রাণে, হৃদয় মগন গানে,
কবি একা জাগে-
কত কথা পুষ্প প্রায় বিকশি তুলিতে চায়
কত অনুরাগে,
একদিন শতবর্ষ আগে।
আজি হতে শতবর্ষ পরে
এখন করিছে গান সে কোন্ নুতন কবি
তোমাদের ঘরে!
আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন
পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে।
আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে
ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে-
হৃদয়স্পন্দনে তব, ভ্রমরগুঞ্জনে নব,
পল্লবমর্মরে,
আজি হতে শতবর্ষ পরে।

অভিমান
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কারে দিব দোষ বন্ধু, কারে দিব দোষ!
বৃথা কর আস্ফালন, বৃথা কর রোষ।
যারা শুধু মরে কিন্তু নাহি দেয় প্রাণ,
কেহ কভু তাহাদের করে নি সম্মান।
যতই কাগজে কাঁদি, যত দিই গালি,
কালামুখে পড়ে তত কলঙ্কের কালি।
যে তোমারে অপমান করে অহর্নিশ
তারি কাছে তারি ‘পরে তোমার নালিশ!
নিজের বিচার যদি নাই নিজহাতে,
পদাঘাত খেয়ে যদি না পার ফিরাতে–
তবে ঘরে নতশিরে চুপ করে থাক্,
সাপ্তাহিকে দিগ্বিদিকে বাজাস নে ঢাক।
একদিকে অসি আর অবজ্ঞা অটল,
অন্য দিকে মসী আর শুধু অশ্রুজল।

দান
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাঁকন-জোড়া এনে দিলেম যবে,
ভেবেছিলেম, হয়তো খুশি হবে।
তুলে তুমি নিলে হাতের ‘পরে,
ঘুরিয়ে তুমি দেখলে ক্ষণেক-তরে,
পরেছিলে হয়তো গিয়ে ঘরে –
হয়তো বা তা রেখেছিলে খুলে।
এলে যেদিন বিদায় নেবার রাতে
কাঁকনদুটি দেখি নাই তো হাতে,
হয়তো এলে ভুলে।।
দেয় যে জনা কী দশা পায় তাকে,
দেওয়ার কথা কেনই মনে রাখে!
পাকা যে ফল পড়ল মাটির টানে
শাখা আবার চায় কি তাহার পানে।
বাতাসেতে-উড়িয়ে-দেওয়া গানে
তারে কি আর স্মরণ করে পাখি?
দিতে যারা জানে এ সংসারে
এমন ক’রেই তারা দিতে পারে
কিছু না রয় বাকি।।
নিতে যারা জানে তারাই জানে,
বোঝে তারা মূল্যটি কোনখানে।
তারাই জানে, বুকের রত্নহারে
সেই মণিটি কজন দিতে পারে
হৃদয় দিতে দেখিতে হয় যারে –
যে পায় তারে সে পায় অবহেলে।
পাওয়ার মতন পাওয়া যারে কহে
সহজ ব’লেই সহজ তাহা নহে,
দৈবে তারে মেলে।।
ভাবি যখন ভেবে না পাই তবে
দেবার মতো কী আছে এই ভবে।
কোন্ খনিতে কোন্ ধনভান্ডারে,
সাগর-তলে কিম্বা সাগর-পারে,
যক্ষরাজের লক্ষমণির হারে
যা আছে তা কিছুই তো নয় প্রিয়ে!
তাই তো বলি যা-কিছু মোর দান
গ্রহণ করেই করবে মূল্যবান
আপন হৃদয় দিয়ে।

অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।
এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো,
কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।
বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,
দেশ বিদেশে কতই ঘুরি –
এবার বলো আমার মনের কোণে
দেবে ধরা, ছলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।
জানি আমার কঠিন হৃদয়
চরণ রাখার যোগ্য সে নয় –
সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়
তবু কি প্রাণ গলবে না।
না হয় আমার নাই সাধনা,
ঝরলে তোমার কৃপার কণা
তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল
চকিতে ফল ফলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।

আকাশের চাঁদ
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হাতে তুলে দাও আকাশের চাঁদ —
এই হল তার বুলি।
দিবস রজনী যেতেছে বহিয়া,
কাঁদে সে দু হাত তুলি।
হাসিছে আকাশ, বহিছে বাতাস,
পাখিরা গাহিছে সুখে।
সকালে রাখাল চলিয়াছে মাঠে,
বিকালে ঘরের মুখে।
বালক বালিকা ভাই বোনে মিলে
খেলিছে আঙিনা-কোণে,
কোলের শিশুরে হেরিয়া জননী
হাসিছে আপন মনে।
কেহ হাটে যায় কেহ বাটে যায়
চলেছে যে যার কাজে —
কত জনরব কত কলরব
উঠিছে আকাশমাঝে।
পথিকেরা এসে তাহারে শুধায় ,
‘কে তুমি কাঁদিছ বসি।’
সে কেবল বলে নয়নের জলে,
‘হাতে পাই নাই শশী।’
সকালে বিকালে ঝরি পড়ে কোলে
অযাচিত ফুলদল,
দখিন সমীর বুলায় ললাটে
দক্ষিণ করতল।
প্রভাতের আলো আশিস-পরশ
করিছে তাহার দেহে,
রজনী তাহারে বুকের আঁচলে
ঢাকিছে নীরব স্নেহে।
কাছে আসি শিশু মাগিছে আদর
কণ্ঠ জড়ায়ে ধরি,
পাশে আসি যুবা চাহিছে তাহারে
লইতে বন্ধু করি।
এই পথে গৃহে কত আনাগোনা,
কত ভালোবাসাবাসি,
সংসারসুখ কাছে কাছে তার
কত আসে যায় ভাসি,
মুখ ফিরাইয়া সে রহে বসিয়া,
কহে সে নয়নজলে,
‘তোমাদের আমি চাহি না কারেও,
শশী চাই করতলে।’
শশী যেথা ছিল সেথাই রহিল,
সেও ব’সে এক ঠাঁই।
অবশেষে যবে জীবনের দিন
আর বেশি বাকি নাই,
এমন সময়ে সহসা কী ভাবি
চাহিল সে মুখ ফিরে
দেখিল ধরণী শ্যামল মধুর
সুনীল সিন্ধুতীরে।
সোনার ক্ষেত্রে কৃষাণ বসিয়া
কাটিতেছে পাকা ধান,
ছোটো ছোটো তরী পাল তুলে যায়,
মাঝি বসে গায় গান।
দূরে মন্দিরে বাজিছে কাঁসর,
বধূরা চলেছে ঘাটে,
মেঠো পথ দিয়ে গৃহস্থ জন
আসিছে গ্রামের হাটে।
নিশ্বাস ফেলি রহে আঁখি মেলি,
কহে ম্রিয়মাণ মন,
‘শশী নাহি চাই যদি ফিরে পাই
আর বার এ জীবন।’
দেখিল চাহিয়া জীবনপূর্ণ
সুন্দর লোকালয়
প্রতি দিবসের হরষে বিষাদে
চির-কল্লোলময়।
স্নেহসুধা লয়ে গৃহের লক্ষ্মী
ফিরিছে গৃহের মাঝে,
প্রতি দিবসেরে করিছে মধুর
প্রতি দিবসের কাজে।
সকাল বিকাল দুটি ভাই আসে
ঘরের ছেলের মতো,
রজনী সবারে কোলেতে লইছে
নয়ন করিয়া নত।
ছোটো ছোটো ফুল, ছোটো ছোটো হাসি,
ছোটো কথা, ছোটো সুখ,
প্রতি নিমেষের ভালোবাসাগুলি,
ছোটো ছোটো হাসিমুখ
আপনা-আপনি উঠিছে ফুটিয়া
মানবজীবন ঘিরি,
বিজন শিখরে বসিয়া সে তাই
দেখিতেছে ফিরি ফিরি।
দেখে বহুদূরে ছায়াপুরী-সম
অতীত জীবন-রেখা,
অস্তরবির সোনার কিরণে
নূতন বরনে লেখা।
যাহাদের পানে নয়ন তুলিয়া
চাহে নি কখনো ফিরে,
নবীন আভায় দেখা দেয় তারা
স্মৃতিসাগরের তীরে।
হতাশ হৃদয়ে কাঁদিয়া কাঁদিয়া
পুরবীরাগিণী বাজে,
দু-বাহু বাড়ায়ে ফিরে যেতে চায়
ওই জীবনের মাঝে।
দিনের আলোক মিলায়ে আসিল
তবু পিছে চেয়ে রহে—
যাহা পেয়েছিল তাই পেতে চায়
তার বেশি কিছু নহে।
সোনার জীবন রহিল পড়িয়া
কোথা সে চলিল ভেসে।
শশীর লাগিয়া কাঁদিতে গেল কি
রবিশশীহীন দেশে।
আছে আমার হৃদয় আছে ভরে,
এখন তুমি যা খুশি তাই করো।
এমনি যদি বিরাজ’ অন্তরে
বাহির হতে সকলই মোর হরো।
সব পিপাসার যেথায় অবসান
সেথায় যদি পূর্ণ করো প্রাণ,
তাহার পরে মরুপথের মাঝে
উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর।
এই যে খেলা খেলছ কত ছলে
এই খেলা তো আমি ভালবাসি।
এক দিকেতে ভাসাও আঁখিজলে,
আরেক দিকে জাগিয়ে তোল’ হাসি।
যখন ভাবি সব খোয়ালাম বুঝি
গভীর করে পাই তাহারে খুঁজি,
কোলের থেকে যখন ফেল’ দূরে
বুকের মাঝে আবার তুলে ধর’।

আচল স্মৃতি
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার হৃদয়ভূমি-মাঝখানে
জাগিয়া রয়েছে নিতি
অচল ধবল শৈল-সমান
একটি অচল স্মৃতি।
প্রতিদিন ঘিরি ঘিরি
সে নীরব হিমগিরি
আমার দিবস আমার রজনী
আসিছে যেতেছে ফিরি।
যেখানে চরণ রেখেছে সে মোর
মর্ম গভীরতম—
উন্নত শির রয়েছে তুলিয়া
সকল উচ্চে মম।
মোর কল্পনা শত
রঙিন মেঘের মতো
তাহারে ঘেরিয়া হাসিছে কাঁদিছে,
সোহাগে হতেছে নত।
আমার শ্যামল তরুলতাগুলি
ফুলপল্লবভারে
সরস কোমল বাহুবেষ্টনে
বাঁধিতে চাহিছে তারে।
শিখর গগনলীন
দুর্গম জনহীন,
বাসনাবিহগ একেলা সেথায়
ধাইছে রাত্রিদিন।
চারি দিকে তার কত আসা-যাওয়া,
কত গীত , কত কথা —
মাঝখানে শুধু ধ্যানের মতন
নিশ্চল নীরবতা।
দূরে গেলে তবু, একা
সে শিখর যায় দেখা —
চিত্তগগনে আঁকা থাকে তার
নিত্যনীহাররেখা।

লজ্জা
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার হৃদয় প্রাণ
সকলই করেছি দান,
কেবল শরমখানি রেখেছি।
চাহিয়া নিজের পানে
নিশিদিন সাবধানে
সযতনে আপনারে ঢেকেছি।
হে বঁধু, এ স্বচ্ছ বাস
করে মোরে পরিহাস,
সতত রাখিতে নারি ধরিয়া–
চাহিয়া আঁখির কোণে
তুমি হাস মনে মনে,
আমি তাই লাজে যাই মরিয়া।
দক্ষিণপবনভরে
অঞ্চল উড়িয়া পড়ে
কখন্ যে নাহি পারি লখিতে।
পুলকব্যাকুল হিয়া
অঙ্গে উঠে বিকশিয়া,
আবার চেতনা হয় চকিতে।
বদ্ধ গৃহে করি বাস
রুদ্ধ যবে হয় শ্বাস
আধেক বসনবন্ধ খুলিয়া
বসি গিয়া বাতায়নে,
সুখসন্ধ্যাসমীরণে
ক্ষণতরে আপনারে ভুলিয়া।
পূর্ণচন্দ্রকররাশি
মূর্ছাতুর পড়ে আসি
এই নবযৌবনের মুকুলে,
অঙ্গ মোর ভালোবেসে
ঢেকে দেয় মৃদু হেসে
আপনার লাবণ্যের দুকূলে–
মুখে বক্ষে কেশপাশে
ফিরে বায়ু খেলা-আশে,
কুসুমের গন্ধ ভাসে গগনে–
হেনকালে তুমি এলে
মনে হয় স্বপ্ন ব’লে,
কিছু আর নাহি থাকে স্মরণে।
থাক্ বঁধু, দাও ছেড়ে,
ওটুকু নিয়ো না কেড়ে,
এ শরম দাও মোরে রাখিতে–
সকলের অবশেষ
এইটুকু লাজলেশ
আপনারে আধখানি ঢাকিতে।
ছলছল-দু’নয়ান
করিয়ো না অভিমান,
আমিও যে কত নিশি কেঁদেছি;
বুঝাতে পারি নে যেন
সব দিয়ে তবু কেন
সবটুকু লাজ দিয়ে বেঁধেছি–
কেন যে তোমার কাছে
একটু গোপন আছে,
একটু রয়েছি মুখ হেলায়ে।
এ নহে গো অবিশ্বাস–
নহে সখা, পরিহাস,
নহে নহে ছলনার খেলা এ।
বসন্তনিশীথে বঁধু,
লহ গন্ধ, লহ মধু,
সোহাগে মুখের পানে তাকিয়ো।
দিয়ো দোল আশে-পাশে,
কোয়ো কথা মৃদু ভাষে–
শুধু এর বৃন্তটুকু রাখিয়ো।
সেটুকুতে ভর করি
এমন মাধুরী ধরি
তোমাপানে আছি আমি ফুটিয়া,
এমন মোহনভঙ্গে
আমার সকল অঙ্গে
নবীন লাবণ্য যায় লুটিয়া–
এমন সকল বেলা
পবনে চঞ্চল খেলা,
বসন্তকুসুম-মেলা দুধারি।
শুন বঁধু, শুন তবে,
সকলই তোমার হবে,
কেবল শরম থাক্ আমারি।

কৃষ্ণকলি
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
পূবে বাতাস এল হঠাত্ ধেয়ে,
ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে,
আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
এমনি করে কাজল কালো মেঘ
জ্যৈষ্ঠমাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ়মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাত্ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার পরে দেয়নি তুলে বাস,
লজ্জা পাবার পায়নি অবকাশ।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।

প্রথম চুম্বন
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্তব্ধ হল দশ দিক নত করি আঁখি
বন্ধ করি দিল গান যত ছিল পাখি।
শান্ত হয়ে গেল বায়ু, জলকলস্বর
মুহূর্তে থামিয়া গেল, বনের মর্মর
বনের মর্মের মাঝে মিলাইল ধীরে।
নিস্তরঙ্গ তটিনীর জনশূন্য তীরে
নিঃশব্দে নামিল আসি সায়াহ্নচ্ছায়ায়
নিস্তব্ধ গগনপ্রান্ত নির্বাক্ ধরায়।
সেইক্ষণে বাতায়নে নীরব নির্জন
আমাদের দুজনের প্রথম চুম্বন।
দিক্-দিগন্তরে বাজি উঠিল তখনি
দেবালয়ে আরতির শঙ্খঘণ্টাধ্বনি।
অনন্ত নক্ষত্রলোক উঠিল শিহরি,
আমাদের চক্ষে এল অশ্রুজল ভরি।

হঠাৎ দেখা
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন।।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লাল রঙের শাড়িতে-
দালিম-ফুলের মত রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলন-চাঁপার মত চিকন-গৌর মুখখানি ঘিরে।
মনে হল, কাল রঙের একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেক্ষেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা:
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে:
আলাপ করলেম শুরু-
কেমন আছো, কেমন চলছে সংসার
ইত্যাদি।
সে রইল জানালার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,
কোনটা বা দিলেই না।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায়-
কেন এ-সব কথা,
এর চেয়ে অনেক ভাল চুপ ক’রে থাকা।।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে ওর সাথিদের সঙ্গে।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।
মনে হল কম সাহস নয়-
বসলুম ওর এক বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
‘কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার!
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
দূরে যাবে তুমি,
তাই, যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো?’
আমি বললাম,বলব।
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
‘আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে-
কিছুই কি নেই বাকি?’
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তার পর বললেম,
‘রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।’
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম নাকি।
ও বললে, ‘থাক এখন যাও ও দিকে।’
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে।
আমি চললেম একা।

অন্তর মম বিকশিত করো
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,
সুন্দর কর হে।
জাগ্রত করো, উদ্যত করো,
নির্ভয় করো হে।
মঙ্গল করো, নরলস নিঃসংশয় করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো,
অন্তরতর হে।
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,
মুক্ত করো হে বন্ধ,
সঞ্চার করো সকল মর্মে
শান্ত তোমার ছন্দ।
চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,
নন্দিত করো, নন্দিত করো,
নন্দিত করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।

আমার এ প্রেম নয়তো ভীরু
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু,
নয় তো হীনবল –
শুধু কি এ ব্যাকুল হয়ে
ফেলবে অশ্রুজল।
মন্দমধুর সুখে শোভায়
প্রেম কে কেন ঘুমে ডোবায়।
তোমার সাথে জাগতে সে চায়
আনন্দে পাগল।
নাচ’ যখন ভীষণ সাজে
তীব্র তালের আঘাত বাজে,
পালায় ত্রাসে পালায় লাজে
সন্দেহ বিহবল।
সেই প্রচন্ড মনোহরে
প্রেম যেন মোর বরণ করে,
ক্ষুদ্র আশার স্বর্গ তাহার
দিক সে রসাতল।

আমার মিলন লাগি তুমি
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার মিলন লাগি তুমি
আসছ কবে থেকে।
তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়
রাখবে কোথায় ঢেকে।
কত কালের সকাল-সাঁঝে
তোমার চরণধ্বনি বাজে,
গোপনে দূত গৃহ-মাঝে
গেছে আমায় ডেকে।
ওগো পথিক, আজকে আমার
সকল পরাণ ব্যেপে
থেকে থেকে হরষ যেন
উঠছে কেঁপে কেঁপে
যেন সময় এসেছে আজ,
ফুরালো মোর যা ছিল কাজ –
বাতাস আসে, হে মহারাজ,
তোমার গন্ধ মেখে।

কত অজানারে জানাইলে তুমি
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কত অজানারে জানাইলে তুমি,
কত ঘরে দিলে ঠাঁই-
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।
পুরনো আবাস ছেড়ে যাই যবে
মনে ভেবে মরি কী জানি কী হবে,
নূতনের মাঝে তুমি পুরাতন
সে কথা যে ভুলে যাই।
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।
জীবনে মরণে নিখিল ভুবনে
যখনি যেখানে লবে,
চির জনমের পরিচিত ওহে,
তুমিই চিনাবে সবে।
তোমারে জানিলে নাহি কেহ পর,
নাহি কোন মানা, নাহি কোন ডর,
সবারে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ-
দেখা যেন সদা পাই।
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।

বাঁশি
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কিনু গোয়ালার গলি।
দোতলা বাড়ির
লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর
পথের ধারেই।
লোনাধরা দেয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি,
মাঝে মাঝে স্যাঁতাপড়া দাগ।
মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি
সিদ্ধিদাতা গণেশের
দরজার ‘পরে আঁটা।
আমি ছাড়া ঘরে থাকে আর একটি জীব
এক ভাড়াতেই,
সেটা টিকটিকি।
তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু,
নেই তার অন্নের অভাব॥
বেতন পঁচিশ টাকা,
সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি।
খেতে পাই দত্তদের বাড়ি
ছেলেকে পড়িয়ে।
শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আসি,
আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।
এঞ্জিনের ধস্ ধস্,
বাঁশির আওয়াজ,
যাত্রীর ব্যস্ততা,
কুলি-হাঁকাহাঁকি।
সাড়ে-দশ বেজে যায়,
তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার॥
ধলেশ্বরী-নদীতীরে পিসিদের গ্রাম—
তাঁর দেওরের মেয়ে,
অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।
লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল—
সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।
মেয়েটা তো রক্ষে পেলে,
আমি তথৈবচ।
ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া—
পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর॥
বর্ষা ঘনঘোর।
ট্রামের খরচা বাড়ে,
মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়।
গলিটার কোণে কোণে
জমে ওঠে, পচে ওঠে
আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,
মাছের কান্কা,
মরা বেড়ালের ছানা—
ছাইপাঁশ আরো কত কী যে।
ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া
মাইনের মতো,
বহু ছিদ্র তার।
আপিসের সাজ
গোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন,
সর্বদাই রসসিক্ত থাকে।
বাদলের কালো ছায়া
স্যাঁত্সেঁতে ঘরটাতে ঢুকে
কলে পড়া জন্তুর মতন
মূর্ছায় অসাড়!
দিনরাত, মনে হয়, কোন্ আধমরা
জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।
গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু—
যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল,
বড়ো বড়ো চোখ,
শৌখিন মেজাজ।
কর্নেট বাজানো তার শখ।
মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে
এ গলির বীভত্স বাতাসে—
কখনো গভীর রাতে,
ভোরবেলা আলো-অন্ধকারে,
কখনো বৈকালে
ঝিকিমিকি আলো-ছায়ায়।
হঠাত্ সন্ধ্যায়
সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান,
সমস্ত আকাশে বাজে
অনাদি কালের বিরহবেদনা।
তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে
এ গলিটা ঘোর মিছে
দুর্বিষহ মাতালের প্রলাপের মতো।
হঠাত্ খবর পাই মনে,
আকবর বাদশার সঙ্গে
হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।
বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে
ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে
এক বৈকুণ্ঠের দিকে॥
এ গান যেখানে সত্য
অনন্ত গোধুলিলগ্নে
সেইখানে
বহি চলে ধলেশ্বরী,
তীরে তমালের ঘন ছায়া—
আঙিনাতে
যে আছে অপেক্ষা ক’রে, তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।

বোঝাপড়া
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
কেউ বা তোমায় ভালোবাসে
কেউ বা বাসতে পারে না যে,
কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা
সিকি পয়সা ধারে না যে,
কতকটা যে স্বভাব তাদের
কতকটা বা তোমারো ভাই,
কতকটা এ ভবের গতিক—
সবার তরে নহে সবাই।
তোমায় কতক ফাঁকি দেবে
তুমিও কতক দেবে ফাঁকি,
তোমার ভোগে কতক পড়বে
পরের ভোগে থাকবে বাকি,
মান্ধাতারই আমল থেকে
চলে আসছে এমনি রকম—
তোমারি কি এমন ভাগ্য
বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
অনেক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বুঝি
এলে সুখের বন্দরেতে,
জলের তলে পাহাড় ছিল
লাগল বুকের অন্দরেতে,
মুহূর্তেকে পাঁজরগুলো
উঠল কেঁপে আর্তরবে—
তাই নিয়ে কি সবার সঙ্গ
ঝগড়া করে মরতে হবে?
ভেসে থাকতে পার যদি
সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয়,
না পার তো বিনা বাক্যে
টুপ করিয়া ডুবে যেয়ো।
এটা কিছু অপূর্ব নয়,
ঘটনা সামান্য খুবই—
শঙ্কা যেথায় করে না কেউ
সেইখানে হয় জাহাজ-ডুবি।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
তোমার মাপে হয় নি সবাই
তুমিও হও নি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে—
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি?
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।
আকাশ তবু সুনীল থাকে,
মধুর ঠেকে ভোরের আলো,
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।
যাহার লাগি চক্ষু বুজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
নিজের ছায়া মস্ত করে
অস্তাচলে বসে বসে
আঁধার করে তোল যদি
জীবনখানা নিজের দোষে,
বিধির সঙ্গ বিবাদ করে
নিজের পায়েই কুড়ুল মার,
দোহাই তবে এ কার্যটা
যত শীঘ্র পার সারো।
খুব খানিকটে কেঁদে কেটে
অশ্রু ঢেলে ঘড়া ঘড়া
মনের সঙ্গ এক রকমে
করে নে ভাই, বোঝাপড়া।
তাহার পরে আঁধার ঘরে
প্রদীপখানি জ্বালিয়ে তোলো—
ভুলে যা ভাই, কাহার সঙ্গে
কতটুকুন তফাত হল।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

মানষী
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী–
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
সঁপিয়া তোমার ‘পরে নূতন মহিমা
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।
কত বর্ণ কত গন্ধ ভূষণ কত-না,
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে খনি হতে সোনা,
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,
চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার।
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।
পড়েছে তোমার ‘পরে প্রদীপ্ত বাসনা–
অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।

প্রেমের হাতে ঘরা দেব
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমের হাতে ধরা দেব
তাই রয়েছি বসে;
অনেক দেরি হয়ে গেল,
দোষী অনেক দোষে।
বিধিবিধান-বাঁধনডোরে
ধরতে আসে, যাই সে সরে,
তার লাগি যা শাস্তি নেবার
নেব মনের তোষে।
প্রেমের হাতে ধরা দেব
তাই রয়েছি বসে।
লোকে আমায় নিন্দা করে,
নিন্দা সে নয় মিছে,
সকল নিন্দা মাথায় ধরে
রব সবার নীচে।
শেষ হয়ে যে গেল বেলা,
ভাঙল বেচা-কেনার মেলা,
ডাকতে যারা এসেছিল
ফিরল তারা রোষে।
প্রেমের হাতে ধরা দেব
তাই রয়েছি বসে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সবার সাথে চলতেছিল অজানা এই পথের অন্ধকারে, কোন্ সকালের হঠাৎ আলোয় পাশে আমার দেখতে পেলেম তারে।।
এক নিমেষেই রাত্রি হল ভোর, চিরদিনের ধন যেন সে মোর পরিচয়ের অন্ত যেন কোনোখানেই নাইকো একেবারে- চেনা কুসুম ফুটে আছে না-চেনা এই গহন বনের ধারে অজানা এই পথের অন্ধকারে।।
জানি আমি দিনের শেষে সন্ধ্যাতিমির নামবে পথের মাঝে- আবার কখন পড়বে আড়াল, দেখাশোনার বাঁধন রবে না যে।
তখন আমি পাব মনে মনে পরিচয়ের পরশ ক্ষণে ক্ষণে; জানব চিরদিনের পথে আঁধার আলোয় চলছি সারে সারে- হৃদয়-মাঝে দেখব খুঁজে একটি মিলন সব-হারানোর পারে অজানা এই পথের অন্ধকারে।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার পরান লয়ে কী খেলা খেলাবে ওগো পরানপ্রিয়।
কোথা হতে ভেসে কূলে লেগেছে চরণমূলে তুলে দেখিয়ো।
এ নহে গো তৃণদল, ভেসে আসা ফুলফল-
এ যে ব্যথাভরা মন মনে রাখিয়ো।
কেন আসে কেন যায়
কেহ না জানে।
কে আসে কাহার পাশে কিসের টানে। রাখ যদি ভালোবেসে চিরপ্রাণ পাইবে সে,ফেলে যদি যাও তবে বাঁচিবে কি ও।॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সুন্দর হৃদিরঞ্জন তুমি নন্দনফুলহার, তুমি অনন্ত নববসন্ত অন্তরে আমার।। নীল অম্বর চুম্বনরত, চরণে ধরণী মুগ্ধ নিয়ত, অঞ্চল ঘেরি সঙ্গীত যত গুঞ্জরে শতবার।। ঝলকিছে কত ইন্দুকিরণ, পুলকিছে ফুলগন্ধ- চরণভঙ্গে ললিত অঙ্গে চমকে চকিত ছন্দ। ছিঁড়ি মর্মের শত বন্ধন তোমা-পানে ধায় যত এন্দন- লহো হৃদয়ের ফুলচন্দন বন্দন-উপহার।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমারে করো তোমার বীণা, উঠিবে বাজি তন্ত্রীরাজি কোমল তব কমলকরে, লহো গো লহো তুলে। মোহন অঙ্গুলে।। পরশ করো পরান-‘পরে, উঠিবে হিয়া গুঞ্জরিয়া তব শ্রবণমূলে।। কখনো সুখে কখনো দুখে কাঁদিবে চাহি তোমার মুখে, চরণে পড়ি রবে নীরবে কেহ না জানে কী নব তানে আনন্দের বারতা যাবে রহিবে যবে ভুলে। উঠিবে গীত শূন্য-পানে, অনন্তের কূলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভালোবেসে, সখী, নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো-তোমার মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে তাহারি তালটি শিখো- তোমার চরণমঞ্জীরে।।
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে আমার মুখর পাখি- তোমার প্রাসাদপ্রাঙ্গণে।
মনে করে, সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো আমার হাতের রাখী- তোমার কনককঙ্কণে।।
আমার লতার একটি মুকুল ভুলিয়া তুলিয়া রেখো- তোমার অলকবন্ধনে।
আমার স্মরণ-শুভ-সিন্দুরে একটি বিন্দু এঁকো- তোমার ললাটচন্দনে।
আমার মনের মোহের মাধুরী মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো- তোমার অঙ্গসৌরভে।
আমার আকুল জীবনমরণ টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো- তোমার অতুল গৌরবে।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ, আরো কী তোমার চাই।
ওগো ভিখারি আমার ভিখারি, চলেছ কী কাতর গান গাই।।
হায় আমি আমার ভুবন শূন্য করেছি তোমার পুরাতে আশ।
প্রতিদিন প্রাতে নব নব ধনে তুষিব তোমারে সাধ ছিল মনে- ভিখারি আমার ভিখারি,
পলকে সকলই সঁপেছি চরণে, আর তো কিছুই নাই।
আমি আমার বুকের আঁচল ঘেরিয়া তোমারে পরানু বাস।
মম প্রাণ মন যৌবন নব করপুটতলে পড়ে আছে তব- ভিখারি আমার ভিখারি,
হেরো হায়, আরো যদি মোরে কিছু দাও, ফিরে আমি দিব তাই।।
চিত পিপাসিত রে
প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্ত পিপাসিত রে গীতসুধার তরে। তাপিত শুষ্কলতা বর্ষণ যাচে যথা কাতর অন্তর মোর লুষ্ঠিত ধূলি-‘পরে গীতসুধার তরে। আজি বসন্তনিশা, আজি অনন্ত তৃষা, আজি এ জাগ্রত প্রাণ তৃষিত চকোর-সমান গীতসুবার তরে। চন্দ্র অতন্দ্র নতে জাগিছে সুপ্ত তবে, অন্তর বাহির আজি কাঁদে উদাস স্বরে গীতসুধার তরে।
আমার দনের মাঝে যে গান বাজে
প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার মনের মাঝে যে গান বাজে শুনতে কি পাও গো আমার চোখের ‘পরে আভাস দিয়ে যখনি যাও গো। রবির কিরণ নেয় যে টানি ফুলের বুকের শিশিরখানি, আমার প্রাণের সে গান তুমি তেমনি কি নাও গোঃ আমার উদাস হৃদয় যখন আসে বাহির-পানে আপনাকে যে দেয় ধরা সে সকলখানে।
কচি পাতা প্রথম প্রাতে কী কথা কয় আলোর সাথে, আমার মনের আপন কথা বলে যে তাও গোর কাহার গলায় পরাবি গানের কর্তনহার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাহার গলায় পরাবি গানের রতনহার,
তাই কি বীণায় লাগালি যতনে নূতন তার।।
কানন পরেছে শ্যামল দুকুল, আমের শাখাতে নূতন মুকুল, নবীনের মায়া করিল আকুল হিয়া তোমার।। যে কথা তোমার কোনো দিন আর হয় নি বলা নাহি জানি কারে তাই বলিবারে করে উতলা। দখিনপবনে বিছুলা ধরা কাকলিকুজনে হয়েছে মুখরা,
অজি নিখিলের বাণীমন্দিরে খুলেছে দ্বার।
যে ছায়ারে ধরব বলে করেছিলেম গণ
প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যে ছায়ারে ধরব বলে করেছিলেম পণ
আজ সে মেনে নিল আমার গানেরই বন্ধন।।
আকাশে যার পরশ মিলায় শরতমেঘের ক্ষণিক লীলায় আপন সুরে আজ শুনি তার নূপুরগুঞ্জন। অলস দিনের হাওয়ায় গন্ধখানি মেলে যেত গোপন আসা-যাওয়ায়। আজ শরতের ছায়ানটে মোর রাগিণীর মিলন ঘটে, সেই মিলনের তালে তালে বাজায় সে কঙ্কণ।
গানগুলি মোর শৈবালেরই দল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গানগুলি মোর শৈবালেরই দল-
ওরা বন্যাধারায় পথ যে হারায়
উদ্দাম চঞ্চল।
গুরা কেনই আসে যায় বা চলে, অকারণের হাওয়ায় দোলে-চিহ্ন কিছুই যায় না রেখে, পায় না কোনো ফল।
ওদের সাধন তো নাই, কিছু সাধন তো নাই, গুদের বাঁধন তো নাই, কোনো বাঁধন তো নাই। উদাস ওরা উদাস করে গৃহহারা পথের স্বরে,
ভুলে-যাওয়ার স্রোতের ‘পরে করে টলোমল।
তোমায় গান শোনাব এই তো আমায়
প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া। বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক’ ওগো দুখজাগানিয়া। এল আঁধার ঘিরে, পাখি এল নীড়ে, তরী এল তীরে-
শুধু আমার হিয়া বিরাম পায় নাকো
ওগো দুখজাগানিয়া।।
আমার কাজের মাঝে মাঝে
কান্নাহাসির দোলা তুমি থামতে দিলে না যে।
আমায় পরশ ক’রে প্রাণ সুধায় ভ’রে
তুমি যাও যে সরে-
বুঝি আমার ব্যথার আড়ালেতে দাঁড়িয়ে থাক
ওগো দুখজাগানিয়া।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গানের ডালি ভরে দে গো ঊষার কোলে-
আয় গো তোরা, আয় গো তোরা, আয় গো চলে। চাঁপার কলি চাঁপার গাছে সুরের আশায় চেয়ে আছে, কান পেতেছে নতুন পাতা গাইবি ব’লে। কমলবরণ গগন-মাকে
কমলচরণ ওই বিরাজে। ওইখানে তোর সুর ভেসে যাক, নবীন প্রাণের ওই দেশে যাক, ওই যেখানে সোনার আলোয় দুয়ার খোলে।
করীসুনাম যুক্তর
ওরে আমার হৃদয় আমার, কখন তোরে প্রভাতকালে দীপের মতো গানের স্রোতে কে ভাসালে।
যেন রে তুই হঠাৎ বেঁকে শুকনো ডাঙায় যাস নে ঠেকে, জড়াস নে শৈবালের জালে।
তীর যে হোখায় স্থির রয়েছে, ঘরের প্রদীপ দেই জ্বালালো-অচল রহে তাহার আলো।
গানের প্রদীপ তুই যে গানে চলবি ছুটে অকূল-গানে চপল ঢেউয়ের আবুল তালে।
কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে
প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে,
তখন তুমি ছিলে না মোর সনে।
যে কথাটি বলব তোমায় বালে কাটল জীবন নীরব চোখের জলে
সেই কথাটি সুরের হোমানলে উঠল জ্বলে একটি আঁধার ক্ষণে-তখন তুমি ছিলে না মোর সনে।।
ভেবেছিলেম আজকে সকাল হলে
সেই কথাটি তোমার যাব বলে।
ফুলের উদাস সুবাস বেড়ায় ঘুরে, পাখির গানে আকাশ গেল পুরে,
সেই কথাটি লাগল না সেই সুরে যতই প্রয়াস করি পরানপণে-যখন তুমি আছ আমার সনে।
মনে রবে কি না রবে আমারে
প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মনে রবে কি না রবে আমারে সে আমার মনে নাই।
ক্ষণে ক্ষণে আমি তব দুয়ারে, অকারণে গান গাই।
চলে যায় দিন, যতখন আছি পথে যেতে যদি আসি কাছাকাছি
তোমার মুখের চকিত সুখের হাসি দেখিতে যে চাই-তাই অকারণে গান গাই।
ফাগুনের ফুল যায় ঝরিয়া ফাগুনের অবসানে-
ক্ষণিকের মুঠি দেয় ভরিয়া, আর কিছু নাহি জানে। ফুরাইবে দিন, আলো হবে ক্ষীণ, গান সারা হবে, থেমে যাবে বীন, যতখন থাকি ভরে দিবে না কি এ খেলারই ভেলাটাই-তাই অকারণে গান গাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আকাশে আজ কোন চরণের আসা-যাওয়া।
বাতাসে আজ কোন পরশের লাগে হাওয়া।
অনেক দিনের বিদায়বেলার ব্যাকুল বাণী
আজ উদাসীর বাঁশির সুরে কে দেয় আনি-
বনের ছায়ায় তরুণ চোখের করুণ চাওয়া।
কোন ফাগুনে যে ফুল ফোটা হল সারা
মৌমাছিদের পাখায় পাখায় কাঁদে
বকুলতলায় কাজ-ভোলা কোন দুপুরে
যে-সব কথা ভাসিয়ে দিলেম গানের সুরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতা বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এই কবিতাগুলো পড়তে পড়তে আমরা প্রেমের নানা রূপের সঙ্গে পরিচিত হই, নিজের অনুভূতিগুলোকে নতুন করে বুঝতে পারি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের গানের লাইন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর প্রেমের গানের লাইন গুলি আজও আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এই লেখায় আমরা কবিগুরুর কিছু অসাধারণ প্রেমের গানের লাইন সম্পর্কে আলোচনা করবো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, গান – সাহিত্যের সকল শাখায়ই তিনি ছিলেন অসামান্য প্রতিভাবান। তাঁর গান গুলি আজও আমাদের মনে প্রেমের অমলিন সুর বাজিয়ে যায়।
কবিগুরুর প্রেমের গানের লাইন:
“আমার সোনার বাংলা, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।” এই লাইনটি কে না জানে! বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা” গানটির এই লাইন গুলি কেবল দেশপ্রেমের কথা বলে না, বরং কবির মাতৃভূমির প্রতি অগাধ অনুরাগেরও প্রকাশ করে।

 

“চোখের জলে লেখা সেই গান গাহিব না আর।” প্রেমের ব্যর্থতার বেদনায় আকুল হৃদয়ের অভিব্যক্তি এই লাইন গুলিতে।

 

“একবার বলো, সখী, রহস্য কী তোমার চোখে।” প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকার গভীর অনুরাগের প্রকাশ এই লাইন গুলিতে।

 

“তুমি এলে বনপথে, ফুল ফুটল সকল পথে।” প্রেমিকের আগমনে প্রকৃতির আনন্দ উচ্ছ্বসিত এই লাইন গুলিতে।

 

“ওগো বকুল পারুল, তোমার নীড় কোথা?” প্রেমিকার সন্ধানে ব্যাকুল প্রেমিকের প্রশ্ন এই লাইন গুলিতে।

 

“হৃদয় আমার ওই বুঝি, পূর্ণ হল আজ।” প্রেমের পরিতৃপ্তির অনুভূতি এই লাইন গুলিতে।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের গানের লাইন গুলি আমাদের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়, আমাদের মনে প্রেমের সঞ্চার করে। এই লাইন গুলি অমর হয়ে থাকবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনন্ত প্রেম

রবীন্দ্রনাথের “অনন্ত প্রেম” কবিতা – জন্মজন্মান্তরের টান, অতীতের স্মৃতি, এবং চিরন্তনের প্রেমের এক অবিস্মরণীয় মধুর স্রোত। এই আর্টিকেলটিতে কবিতাটি বিশ্লেষণ, এর সৌন্দর্য, ও তাৎপর্য আলোচনা করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যজগতে প্রেমের সুর বরাবরই মুখ্য। তাঁর অসংখ্য কবিতায় আমরা পেয়েছি প্রেমের নানা রূপ – রোমান্টিক, আধ্যাত্মিক, দেশাত্মবোধক। কিন্তু “অনন্ত প্রেম” কবিতাটি একটু আলাদা। এখানে প্রেম কেবল দুই মনের মিল নয়, বরং এটি জন্মজন্মান্তরের টান, আত্মার গভীরে লুকিয়ে থাকা অতীতের স্মৃতি, এবং চিরন্তনের প্রেমের মধুর স্রোত।
কবিতার শুরুতেই কবি বলেন, “তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শত বার”। এই একটি লাইনেই যেন কয়েক জন্মের গল্প ফুটে উঠেছে। প্রিয় মানুষটি জন্মে জন্মে রূপ বদলেছে, কিন্তু প্রেমের টান অটুট রয়েছে।
এরপর কবি তাঁর প্রেমের ইতিহাস খুঁজতে চান অতীতের গল্পগুলোতে। “যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা, অতি পুরাতন বিরহমিলনকথা”। প্রশ্ন জাগে, এই সব গল্প কি সত্যি, নাকি মনেরই কল্পনা? কিন্তু প্রেমিকের মনে তো তাই মনে হয়, যেন অতীতেও তিনি তাঁর প্রেমিকাকেই ভালোবেসেছিলেন।
কবিতার সবচেয়ে সুন্দর অংশটি হলো শেষ চার লাইন:
  • জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
  • চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারার বেশে
  • অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে
  • পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।
এই চার লাইনেই রয়েছে কবিতার সারমর্ম। প্রেম অনিবার্য, চিরন্তন। এটি জন্মে জন্মে নতুন রূপ নেয়, কিন্তু এর মূল সত্ত্বা অপরিবর্তিত থাকে।
“অনন্ত প্রেম” কবিতাটি শুধু একটি প্রেমের কবিতা নয়। এটি সময়ের অতিক্রম, আত্মার অমরত্ব, এবং প্রেমের অসীমতার কথা বলে। এই কবিতাটি পড়লে মনে হয়, যেন আমাদের নিজেরই অতীতের কোন প্রেমের গল্প শুনছি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেরা প্রেমের কবিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত প্রেমের কবিতাগুলির একটি সংকলন, যা হৃদয়কে ছুঁয়ে যাবে এবং আপনাকে প্রেমের রহস্যের দিকে ধাবিত করবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার বিখ্যাত কবি, লেখক এবং দার্শনিক, প্রেমের অনন্য বার্তাবাহক হিসেবে খ্যাত। তার কবিতাগুলি প্রেমের সকল দিককে স্পর্শ করে, আনন্দ থেকে বেদনা, আকাঙ্ক্ষা থেকে পূর্ণতা পর্যন্ত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা সাহিত্যের একজন অমর কবি, যিনি কেবল লেখক হিসেবেই নয়, একজন দার্শনিক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং চিত্রশিল্পী হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার সাহিত্যকর্ম বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার জয়ী প্রথম বাঙালি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা, বিশেষ করে তার প্রেমের কবিতা, আজও পাঠকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেরা ৯টি প্রেমের কবিতা:
“চোখের বালি”:
এই কবিতাটিতে কবি প্রেমের অপূর্ণতার কথা তুলে ধরেছেন। প্রেমিক-প্রেমিকা একে অপরকে ভালোবাসে, কিন্তু তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না।
“সোনার তরী”:
এই কবিতাটিতে কবি প্রেমকে একটি সোনার তরীর সাথে তুলনা করেছেন। তরীটি জীবনের সমুদ্রে ভেসে বেড়ায় এবং প্রেমিক-প্রেমিকা একে অপরের সঙ্গ পায়।
“তোমারই হৃদয়ের মাঝে”:
এই কবিতাটিতে কবি প্রেমিকের হৃদয়ের মধ্যে প্রেমিকার অস্তিত্বের কথা তুলে ধরেছেন। প্রেমিকার ভালোবাসা প্রেমিককে সম্পূর্ণ করে তোলে।
“শুধু তোমার জন্য”:
এই কবিতাটিতে কবি প্রেমিকের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কথা তুলে ধরেছেন। প্রেমিক শুধু প্রেমিকার জন্যই বেঁচে থাকতে চায়।
সোনার তরী:
“তোমারে পেয়ে যদি ভাগ্য হয় / তোমারে হারিয়ে যদি হয় / তবুও আমি গাইব গান / তোমারেই গান / তোমারেই গান।”
চোখের জল:
“চোখের জল ধরে রাখো না / তোমার বেদনা লুকোয়ো না / হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি / প্রকাশ করো নির্ভয়ে।”
একবার দেখেছিলে:
“একবার দেখেছিলে / দুবার দেখার সাধ্য কোথায় / প্রেমের গভীরতায় / হারিয়ে গেলাম অচেতন।”
তোমার প্রেমের আঁচলে:
“তোমার প্রেমের আঁচলে / পেয়েছি নতুন জীবন / ভুলে গেছি সকল দুঃখ / পেয়েছি অমরত্বের স্পর্শ।”
চাঁদের সাথে:
“চাঁদের সাথে রাত জাগি / তোমার কথা ভেবে / মনের আকাশে তারা জ্বলে / তোমার স্মৃতির আলোয়।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তার কবিতাগুলিতে প্রেমের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। আজও তার কবিতা পাঠকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় এবং তাদের ভালোবাসার অনুভূতিকে আরও গভীর করে তোলে।

রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর –  এ নামটি বাঙালি মনের কাছে শুধু একজন কবি নন, এক প্রেরণা, এক গর্ব। পঞ্চাশের বেশি কাব্যগ্রন্থের স্রষ্টা তিনি, প্রতিটিতেই ফুঁটে উঠেছে মানব জীবনের নানান রস, দর্শন ও চিন্তাধারা। কিন্তু এতো বিপুল সৃষ্টির মধ্যে কোনগুলোকে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা বলা যায়?
এ প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া কঠিন। কারণ “শ্রেষ্ঠ” এর সংজ্ঞা ব্যক্তি ও আবেগনির্ভর। যে কবিতা একজনের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, হয়তো অন্যজনের কাছে তা সাধারণ মনে হতে পারে। তাই এখানে রবীন্দ্রনাথের কিছু অমর কবিতা তুলে ধরা হলো, যা বিভিন্ন কারণে বাঙালি মনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করেছে:
  • চিত্রা: বিরহের তীব্র অনুভূতি ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের মেলবন্ধন এই কবিতাকে অনন্য করে তুলেছে।
  • একটি হাসি: প্রেমের সারল্য ও নিঃস্বার্থতার চিত্র তুলে ধরেছে এই কবিতা, মনের কোণে আজও হাসি ফোটায়।
  • ধর্মসঙ্গীত: আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা ও ঈশ্বরের প্রতি আকর্ষণকে মনোমুগ্ধকর ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছে এই কবিতা।
  • আমার সোনার বাংলা: বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, এই কবিতা প্রতিটি বাঙালির মনে জাগিয়ে রাখে দেশপ্রেমের অনল।
  • চলে যাবি যেখানে চলে যায় সব: জীবনের চিরন্ত্র সত্য ও মৃত্যুরূপক এই কবিতা পাঠককে গভীর চিন্তায় ডুবিয়ে দেয়।
  • চিরকুলে: এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্বের কথা বলেছেন। প্রকৃতির চিরন্ত চলাচলের সাথে তুলনা করে তিনি আমাদের জীবনের দ্রুত গতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কবিতার শেষ লাইন – “চিরকুলে তোমারি সহস্র নাম, চিরকুলে তোমারি অনন্ত ধাম,” প্রত্যেকবারই আমাদের চিন্তাশক্তিকে প্রশ্ন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।
  • যেথা জীবন ধারা: এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ অসীম জীবনের গান গেয়েছেন। তিনি বলেন, জীবন শুধু আমাদের শরীরেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং চারপাশে সর্বত্রই বিরাজ করছে। এই কবিতা আমাদেরকে প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে এবং জীবনের প্রতি আরও কৃতজ্ঞ হতে শেখায়।
  • ফুলের ফোটা: এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ প্রেমের অপরিসীম শক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি একটি ফুলের ফোটার সাথে তুলনা করে দেখিয়েছেন কীভাবে প্রেম সব বাধা অতিক্রম করে ফুটে উঠতে পারে। এই কবিতা আমাদেরকে প্রেমের সাহস ও সৌন্দর্যের কথা ভাবিয়ে দেয়।
  • একলা চলো রে: এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ সত্যের পথে একা চলার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ভিড়ের সাথে চলা সহজ, কিন্তু সত্যের পথ একাকী হাঁটতে হবে। এই কবিতা আমাদেরকে সত্যের জন্য লড়াই করার এবং নিজের বিশ্বাসে অটল থাকার শক্তি দেয়।
  • ধন্য ধন্য চেতনা: এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ মানবতার প্রতি গভীর বিশ্বাস ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, মানব মনে যে চেতনা আছে, তাই এই জগতের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই চেতনাকে জাগিয়ে তুলেই আমরা একটি সুন্দর পৃথিবী গড়তে পারি।
এছাড়াও অসংখ্য অনন্য কবিতা রয়েছে রবীন্দ্রনাথের রচনাবলীতে। প্রেম, প্রকৃতি, সমাজ, দেশ, আধ্যাত্মিকতা – সবকিছুকেই অসামান্য সৌন্দর্য ও গভীরতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। তাই রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তে পড়তে নিজের মনকে খুঁজে পাওয়া, দেশ ও জীবনের নতুন দিকগুলো আবিষ্কার করা যায়। তাই আপনিও যদি এখনো তাঁর অমর সৃষ্টির স্পর্শ পাননি, তাহলে আজই শুরু করুন – আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছে অবিস্মরণীয় এক সাহিত্য সমুদ্র।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত প্রেমের কবিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা অমর প্রেমের কবিতাগুলির একটি সংকলন, যা আজও পাঠকদের মনে রোমান্সের স্পন্দন জাগিয়ে তোলে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু একজন লেখক, দার্শনিক, এবং সমাজ সংস্কারকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ প্রেমিকও। তার প্রেমের অনুভূতি ফুটে উঠেছে তার অসংখ্য কবিতায়।
বিখ্যাত প্রেমের কবিতা:
সোনার তরী: রবীন্দ্রনাথের অন্যতম বিখ্যাত প্রেমের কবিতা। এই কবিতায় কবি প্রেমিকের হৃদয়কে একটি সোনার তরীর সাথে তুলনা করেছেন, যা প্রেমিকার প্রতি তার আকুল আকাঙ্ক্ষাকে বহন করে।
চোখের বালি: বিরহের বেদনায় জর্জরিত প্রেমিকের অনুভূতি ফুটে উঠেছে এই কবিতায়।
তুমি এলে: প্রেমের আনন্দে উচ্ছ্বসিত প্রেমিকের মনের কথা ফুটে উঠেছে এই কবিতায়।
সে আসে না: প্রেমিকার অপেক্ষায় ব্যাকুল প্রেমিকের মনের অবস্থা ফুটে উঠেছে এই কবিতায়।
একবার দেখা দিলে: বিরহী প্রেমিকের প্রেমিকার প্রতি আকুল আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে এই কবিতায়।
সোনার তরী:
“তোমারি মুখের বাণী আমার কানে বাজে,
তোমারি চোখের জ্যোতি আমার চোখে ঝলকে।”
চোখের বালি:
“তুমি এলে আমার জীবনে,
আলো এলো অন্ধকারে।”
তোমারই হব:
“তোমারই হব, তোমারই হব,
জীবন দিব, মরণ দিব।”
সাগরতীরে:
“একবার দেখা দাও,
এই মরুভূমিতে ফুল ফোটাবো।”
ওগো বিদায়:
“বিদায়, বিদায়, বিদায়,
হৃদয় বিদারক এই বিদায়।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের কবিতাগুলি শুধু রোমান্টিকতার জন্যই নয়, বরং তাদের গভীর অনুভূতি এবং সাবলীল ভাষার জন্যও বিখ্যাত। আজও, এই কবিতাগুলি পাঠকদের মনে প্রেমের স্পন্দন জাগিয়ে তোলে এবং তাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ক্যাপশন

রবীন্দ্রনাথের অমৃত কবিতা – সেই সুগন্ধি, সেই ভাব, সেই অনুভূতি… কখনও কি ভেবেছেন, আপনার ছবির সঙ্গে সেই কবিতার কিছু অংশ শেয়ার করলে কেমন হবে? হ্যাঁ, ঠিক শুনলেন! রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে আপনার ছবি আরও গভীর, সার্থক, এবং আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু কীভাবে? চলুন, জেনে নেওয়া যাক-
১. ছবির সঙ্গে মিলিয়ে কবিতা বেছে নিন:
প্রথমেই খুঁজুন এমন একটি কবিতা, যা আপনার ছবির মেজাজের সঙ্গে মিলে যায়। প্রকৃতির ছবির সঙ্গে “আকাশপ্রদীপ জ্বলে উঠেছে” ব্যবহার করা যেমন সুন্দর, তেমনি মৃদু হাসির ছবির সঙ্গে “কি দুঃখ আছে, কি আনন্দ আছে” লেখাটাও মানায়।
২. কবিতার সারমর্ম ধরুন:
কবিতাটি পুরোপুরি না লিখে, তার সারমর্ম ধরে কয়েকটি লাইন বা একটি মূল চিন্তাভাবনা ক্যাপশনে ব্যবহার করুন। এতে ক্যাপশন সংক্ষিপ্ত ও আকর্ষণীয় হবে।
৩. নিজের অনুভূতি যোগ করুন:
কবিতার লাইনের সঙ্গে নিজের অনুভূতিও যোগ করুন। এতে ক্যাপশনটি আরও ব্যক্তিগত ও আন্তরিক হয়ে উঠবে।
৪. হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করুন:
#রবীন্দ্রনাথ_ঠাকুর, #কবিতা, #বাংলা, #ছবি, #আনন্দ, #মন, #প্রকৃতি ইত্যাদি হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে আপনার পোস্ট আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করুন।

অপেক্ষা কবিতা রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্মে মানবজীবনের নানা অনুভূতির অপূর্ব চিত্রায়ন পাওয়া যায়। তার একটি চিরন্তন কবিতা হলো “অপেক্ষা”। এই কবিতাটি মাত্র কয়েকটি লাইনেই অপেক্ষার তীব্রতা, বেদনা, আর আশা-নিরাশ খেলাকে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছে, যা পাঠকের মনে গভীর ছাপ ফেলে।
কবিতাটি শুরু হয় সন্ধ্যা নামার এক স্থির চিত্র দিয়ে। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে, কিন্তু সন্ধ্যা এখনো ঘনিয়ে ওঠেনি। এই অস্থির মুহূর্তে কবি প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের মাধ্যমে অপেক্ষার বিষাদময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। মেঘমালা আকাশে ঝুলে আছে, দিন যেন চলে যেতেই চায় না, ঘুঘুর ডাক আরো বেদনার সুর তৈরি করে। এই সবকিছুই যেন সেই মানুষের মনের প্রতিফলন, যে অপেক্ষা করে আছে তার প্রিয়জনের জন্য।
কবিতায় বধূরের আগমনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু সে এখনো আসেনি। আলো-আঁধারির এই সন্ধিক্ষণে মনে হয় যেন প্রকৃতিও তার আগমনের অপেক্ষায় রয়েছে। নদীর ঢেউয়ের নৃত্য, রশ্মিরাশির ঝলকানি, বাতাসের শীতল ছোঁয়া — সবকিছুই যেন তার আসার আশায় উদ্বেলিত।
কবিতার শেষ লাইনে কবি একটি প্রশ্ন রেখেছেন, “দিবসশেষে বাহিরে এসে সেও কি এতখনে?” এই প্রশ্নটির মধ্যে আছে অপেক্ষার যন্ত্রণা, আশা এবং অনিশ্চয়তার এক অদ্ভুত মিশেল। পাঠকের মনেও এই প্রশ্ন জাগে, সে কি এসেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর কবি দেননি। তিনি চেয়েছেন পাঠকদের নিজেদের অভিজ্ঞতা, আশা, এবং বেদনা থেকে উত্তর খুঁজে নিতে।
রবীন্দ্রনাথের “অপেক্ষা” কবিতাটি শুধু একটি মানুষের অপেক্ষার কথা বলেনি। এটি আমাদের সবার জীবনেরই কোনো না কোনো মুহূর্তের প্রতিফলন। আমরা সবাই কখনো না কখনো অপেক্ষা করি, কারো জন্য, কোনো কিছুর জন্য। এই কবিতাটি আমাদের সেই অপেক্ষার তীব্রতা, আশা-নিরাশা, এবং জীবনের অস্থিরতাকে অনুভব করিয়ে দেয়।

রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতা আবৃত্তি

আপনার মনে কি শ্রাবণের মেঘের মতো রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতা ভেসে আসে? মায়ের কোলে শোনা সেই “চল চল চল” থেকে শুরু করে, ক্লাসরুমে আবৃত্তি করা “আজি বসন্ত এল” পর্যন্ত, রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতাগুলো আমাদের সবার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। তাহলে কেন না সেই সুরাল আবৃত্তির মাধ্যমে আরও বেশি মানুষকে ছুঁয়ে না দেন?
আজকে আপনাকেই রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতা আবৃত্তি করার আহ্বান জানাচ্ছি! চিন্তা করবেন না, এটি কোনো জটিল প্রক্রিয়া নয়। মাত্র কয়েকটি টিপস মেনে চললেই আপনিও মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বচ্ছন্দে আবৃত্তি করতে পারবেন।
প্রথমেই, আপনার পছন্দের কবিতাটি বাছুন। এমন একটি কবিতা বেছে নিন যা আপনার মনে গভীরভাবে লেগেছে এবং আপনি যা আবেগের সঙ্গে আবৃত্তি করতে পারবেন।
দ্বিতীয়ত, কবিতার অর্থ বুঝুন। শব্দের অর্থের গভীরে নামুন, প্রতিটি শব্দে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের দর্শন খুঁজে বের করুন। এতে আপনার আবৃত্তি আরও প্রাণবন্ত হবে।
তৃতীয়ত, অনুশীলন করুন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কবিতাটি আবৃত্তি করুন। আপনার শরীরী ভাষা, কন্ঠস্বর, এবং অভিব্যক্তি নিয়ে পরীক্ষা করুন।
চতুর্থত, সঠিক পরিবেশ তৈরি করুন। যদি মঞ্চে আবৃত্তি করছেন, তাহলে আলো, সাজসজ্জা, এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ব্যবহার করতে পারেন। যদি অনলাইনে আবৃত্তি করছেন, তাহলে সুন্দর ব্যাকগ্রাউন্ড এবং সঠিক আলো ব্যবহার করুন।
শেষে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আবৃত্তি করুন। মনে রাখবেন, আপনি কেবল কবিতা আবৃত্তি করছেন না, আপনি রবীন্দ্রনাথের প্রেমের অমর সুর ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় প্রেমের অমর সুর আপনাকেও আকর্ষণ করবে। তাঁর কবিতা পড়ুন, অনুভব করুন, আর নিজের মনের মধ্যে প্রেমের নতুন দিগন্ত খুঁজে পান।
Scroll to Top