ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা

ইতিহাসের পাতায় ফরাসি বিপ্লব একটি যুগান্তকারী ঘটনা। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে, নবজাগরণের আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে নব-ফ্রান্স। এই বিপ্লবের পেছনে ছিল বহুবিধ কারণ, তার মধ্যে অন্যতম হলো জ্ঞানদীপ্তি যুগের দার্শনিকদের অবদান।
ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা
ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯) ছিল ইউরোপের ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই বিপ্লব শুধু ফ্রান্সেই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন আনে না, বরং সমগ্র ইউরোপ ও বিশ্বে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।
এই বিপ্লবের পেছনে অবশ্যই বহু কারণ ছিল, কিন্তু দার্শনিকদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞানদীপ্তির আলোয় অনুপ্রাণিত দার্শনিকরা সমাজের অসাম্য, স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তাদের চিন্তাভাবনা বিপ্লবের জন্য অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা দিয়েছিল।
দার্শনিকদের অবদান:
স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধারণা প্রচার: ভলতেয়ার, রুশো, মন্টেস্কিউ, দ্যিদ্রো-এর মতো দার্শনিকরা মানুষের মৌলিক অধিকার, স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধারণা প্রচার করেছিলেন। তাদের লেখার মাধ্যমে এই ধারণাগুলি সমাজের সকল স্তরে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপ্লবী চেতনার জন্ম দেয়।
স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সমালোচনা: ভলতেয়ার, রুশো, মন্টেস্কিউ রাজাদের ঈশ্বরদত্ত অধিকারের ধারণাকে ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ করেছিলেন। তারা রাজাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন এবং জনগণের সার্বভৌমত্বের নীতি প্রতিষ্ঠার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন।
ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই: ভলতেয়ার, দ্যিদ্রো, হেলভেসিয়াস ধর্মীয় কুসংস্কার ও গির্জার অধিকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তারা যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার উপর জোর দিয়েছিলেন।
নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার নকশা প্রণয়ন: রুশো, মন্টেস্কিউ, দ্যিদ্রো নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। তারা গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ক্ষমতার ভারসাম্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি নীতির উপর ভিত্তি করে নতুন সমাজের কাঠামো গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন।
কিভাবে তাদের চিন্তাধারা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা করেছিল:
১. স্বাধীনতা ও সমতার ধারণা:
  • মন্টেস্কিউ: ‘আইনের আত্মা’ বইয়ে তিনি ক্ষমতার বিভাজনের ধারণা দেন যা রাজতন্ত্রের স্বৈরাচারী ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
  • রুশো: ‘সামাজিক চুক্তি’ বইয়ে তিনি জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণা দেন যা রাজাদের ‘ঈশ্বরদত্ত’ অধিকারকে ভেঙে চুরমার করে।
  • ভলতেয়ার: ‘জ্ঞানের অভিধান’ বইয়ে তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে সমাজে যুক্তিবাদ ও নৈতিকতার প্রসার ঘটান।
২. সমাজের ন্যায়বিচার ও সাম্যের ধারণা:
  • ফিজিওক্র্যাট: কৃষিকে অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে দেখিয়ে এবং সামাজিক শ্রেণীবিভাগের বিরুদ্ধে কথা বলে তারা সাম্যের ধারণার বিকাশে অবদান রাখে।
  • মারেচাল: ‘অপরাধের আত্মা’ বইয়ে তিনি অপরাধের কারণ বিশ্লেষণ করে শাস্তি ব্যবস্থার সংস্কারের পক্ষে মতামত দেন।
৩. গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারের ধারণা:
  • রোবসপিয়ের: ‘জ্যাকোবিন’ ক্লাবের নেতা হিসেবে তিনি ‘জনগণের ইচ্ছাই আইন’ এই ধারণার প্রচার করে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
  • ডেসমোলিন্স: ‘ফ্রান্সের জনগণের অধিকার’ বইয়ে তিনি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানান।
  • দার্শনিকদের চিন্তাধারা কেবল বিদ্রোহের সূচনা করেই থেমে থাকেনি, বরং বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
উপসংহার:
ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তাদের চিন্তাভাবনা ও লেখালেখি বিপ্লবের জন্য অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। তাদের ধারণাগুলি আধুনিক গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
Scroll to Top